নিঝুম দ্বীপে যাওয়াটা মোটামুটি আমাদের প্ল্যানের বাইরে ছিল। যাওয়ার দিনও অনি আর আমি জানতামনা যে যাবো কিনা। ঠিকঠিক সূর্য যখন মাথার উপর তখন রবীন্দ্র সরোবরে বসে সাথে ভদ্রলোকের কাছে জেদ চেপে বসলাম যে যাবোই। একটা ব্যাপার নিয়েই খটকা ছিল, তা হলো নিরাপত্তার ব্যাপার।
অবশেষে যখন মানাতে সক্ষম হলাম তখন ঠিক করলাম তখন ব্যাগ কোনো রকমে গুছিয়ে লঞ্চ ধরতে বের হয়ে পড়লাম।পথে এমন বিশাল জ্যামে পড়লাম যে মনে হচ্ছিল, ‘যাহ! এই বুঝি যাওয়া হলো না!’ তবে ভাগ্য ভালো ছিল। কাঁটায় কাঁটায় লঞ্চ ছাড়ার সময়ে পৌঁছালাম।একটা কেবিন নিলাম ব্যাগপত্র রাখার জন্য। দিতে হলো গুণে গুণে ৯৫০টাকা।
৫.৩০ এ লঞ্চ ছাড়লো আর সেই সাথে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
ছোট একটা দ্বীপ নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মধ্যে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অবস্থিত এই ছোট দ্বীপটিতে রয়েছে মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ, আছে নিঃসঙ্গ সমুদ্র তট আর আছে কিছু বন্ধুবৎসল মানুষ।
ঢাকা শহরে যানজট আর মানুষের ভিড়ে দম আটকে আসছিল। তাই এমন একটা জায়াগায় যেতে চাচ্ছিলাম যেখানে মানুষ থাকবে কম, নিজের মতো শ্বাস ফেলতে পারবো। এজন্যই নিঝুম দ্বীপকে বেছে নিয়েছিলাম।
আমাদের লঞ্চ হাতিয়ায় এসে ভিড়লো সকাল বেলা। এখন উঠতে হবে বাইকে। মোটামুটি দুই ঘণ্টার জার্নি। বলাবাহুল্য, বাইকে আমি এর আগে দু’বার উঠেছি কেবল মাত্র, তাই কিঞ্চিৎ ভয় হচ্ছিল উলটে না পড়ে যাই! তা সে যা-ই হোক, ঘাটের থেকেই দু’জন বাইকে উঠলাম। আমরা গিয়েছিলাম মে মাসে, তখন নিঝুম দ্বীপের অফ সিজন চলে। রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব একটা ভালো না৷ যাওয়ার মাঝেই কয়েকবার করে থামতে হচ্ছিল বৃষ্টির কারণে। অর্ধেক রাস্তা গিয়ে শুনলাম সামনের রাস্তায় কাদার কারণে একটা বাইক যাত্রীসহ উলটে গেছে। শুনে বেশ ভয় লাগছিল তবে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন যে করেই হোক যাবো। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি একটু নামতে আমরা আবার রওনা হলাম। একহাত পিছে ব্যাগের স্ট্র্যাপ ধরা আর আরেক হাত দিয়ে অনিকে ধরে রেখেছিলাম। দুইঘণ্টা পর পৌঁছালাম বন্দর টিলা ঘাটে, সেখান থেকে স্পিডবোটে করে এরপর আবার বাইকে করে দুপুর নাগাদ পৌঁছালাম নিঝুম দ্বীপে।
যাওয়ার পথেই দেখছিলাম প্রকৃতি অপরূপ রূপে সাজিয়েছে দ্বীপটাকে। যেতে যেতেই চোখে পড়লো হরিণ যাবার রাস্তা।নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারের মতো। এছাড়াও শীতকালে দ্বীপে সরালি, জিরিয়া, লেনজা, পিয়ং, রাঙ্গামুড়ি, ভূতিহাঁস, কাদা খোঁচাসহ অন্যান্য স্থানীয় পাখি দেখা যায়। দ্বীপে হরিণ ছাড়াও রয়েছে বন্যশূকর, শেয়াল, বানর আর নানা রকমের সাপ।
হোটেলে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হবো বলে ঠিক করলাম। কিন্তু এদিকে টিপটিপ করে বৃষ্টি বেড়েই চলছে। কমে আসতেই আমরা ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু বেশি দূর যাওয়া হলোনা। শুরু হলো ঝড় আর সাথে প্রচন্ড বজ্রপাত! কাছেই ছিল ওয়াচ টাওয়ার। সেখানেই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হলো। ওয়াচ টাওয়ারটা বেশ উঁচু ছিল, উপর থেকে পুরো দ্বীপটা দেখা যাচ্ছিল। এত আশ্চর্য রকমের সুন্দর লাগছিল চারপাশ! খেয়াল করলাম কাছেই একটা কাঠের সেতু, তার উপরে লাল লাল কিছু ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছিল পটে আঁকা কোনো ছবি। সেইদিন এই দৃশ্য দেখে দেখেই বিকেল পার করলাম।
পরদিন বিকেলে আমরা সৈকত দেখতে বের হলাম। এত বিশাল আর নিঃসঙ্গ সৈকত হার মানায় অন্য সৈকতগুলোকেও। বীচে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোও মনে হচ্ছিল নিজের নিঃসঙ্গতাকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলছিল। তখন মনে হচ্ছিল, সত্যিকার অর্থে দ্বীপে আসা সফল হয়েছে।নিজের মত করে শ্বাস নিতে পারছিলাম।
সৈকতে আমরা প্রায় চারঘণ্টার মতো ছিলাম। এর মধ্যে শুধু দু’জন জেলে এসেছিল জাল ফেলতে। আর পুরো সৈকতে আমরা দু’জন! এত শান্তি আর স্বস্তি লাগছিল। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্ত দেখেছিলাম সেদিন।
পরদিন আমাদের ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বীপটা এত ভালো লেগে ছিল যে মুখ ফুটে অনিকে বলে বসলাম, ‘আরেকটা দিন থাকি, কি বলো?’ সেও সাথে সাথে রাজি! সেই দিন আমরা একটু সন্ধ্যের দিকে বের হয়েছিলাম। বীচের কাছাকাছি যেতেই বল এসে পায়ে টোকা লাগে।অনিকে দেখেই বুঝলাম তার এখনি ইচ্ছা করছে মাঠে নেমে পড়তে। কিন্তু নিতান্ত লজ্জার বশে দু’জনকেই দর্শক হয়ে থাকতে হলো।
সন্ধ্যার দিকে বীচটাকে আরো মায়াময় লাগে। আকাশ আভাস দিচ্ছিলো ঝড়ের। চারদিক নিস্তব্ধ, সুনসান। আকাশের রংটা সেদিন এত সুন্দর লাগছিল! চারদিকে একটা রহস্যের ছায়া মনে হচ্ছিল নেমে এসেছে। বীচ থেকে ফেরার পথে অনির জুতো গেল ছিঁড়ে! তাকে খালিপায়ে হাটতে দেখে আমিও ঝটপট জুতো খুলে হাঁটা দিলাম। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বালু পায়ে লেগে এত আরাম দিচ্ছিলো! ভয় হচ্ছিল এত ঠাণ্ডায় অসুখ না বাঁধিয়ে বসি।হোটেলে ফিরে কিছুটা মনখারাপ হচ্ছিল যে আমার হরিণ দেখা হলোনা। আমরা দুইজন হোটেলের বারান্দায় বসেছিলাম।এরই মধ্যে অনি ডাক দিয়ে দেখাল হোটেলের সামনে দুটো হরিণ এসেছে। আগের দিনের কিছু ভাত বাটিতে ছিল, তা নিয়েই দৌড়ে নামলাম নিচে।মানুষ দেখে হরিণ দুটো প্রথমে একটু ভয় পাচ্ছিল, পরে নিজেরাই এগিয়ে আসে। বাটি থেকে দ্রুতই সাবাড় করে ফেলে ভাতগুলো।আমরাও কিছু ছবি তুলে পরে রাতের খাবারের জন্য বের হই।
তবে হরিণ দেখার জন্য ভোরে উঠে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আমাদের বাজেটে টান পড়তো বলে আমরা এ কাজ করিনি।বিকেল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে কবিরাজের চরের কাছে চৌধুরী খাল দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই হরিণের দেখা পাওয়া যায়।এছাড়া ট্রলার রিজার্ভ নিলে মাঝিরাই হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসে। ট্রলার ভাড়া করতে গুণতে হবে ১০০০-১২০০ টাকা।কবিরাজের চরে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আরও দেখা মিলবে মহিষের পালের।
নিঝুম দ্বীপের বাজারেই অনেক খাবারের দোকান আছে। দামও খুব একটা বেশি না। সকালের নাস্তাসহ, মাছ ভাত আর কাঁকড়াও পাওয়া যায় এখানে। তবে এখানে হোটেল শেরাটন নামের একটি হোটেলের খাবারের মান অনেক ভালো। এছাড়া রাতে সমুদ্রপাড়ে বার-বি-কিউ করার সুযোগ রয়েছে। সকাল-সন্ধ্যায় ফ্রেশ খেজুরের রসও চাইলে পাওয়া যায় ১৫-২০ টাকা দামে।
আসার পথে আমরা একটুর জন্য মাছ ধরার ট্রলার মিস করি। মাত্র ২০০ টাকা দিয়ে তাহলে হাতিয়া ফেরত আসা যেত।তবে যাওয়ার বাইক রাইডটিও কম রোমাঞ্চ করছিল না।
বঙ্গোপসাগরের কোলে সমুদ্র বালুচরবেষ্টিত এই ছোট সবুজ ভূখণ্ডটি যে কারও মন কেড়ে নিতে বাধ্য। দিনে দিনে দুবার জোয়ার-ভাটার এই দ্বীপের এক পাশ ঢেকে আছে সাদা বালুতে, আর অন্য পাশে সৈকত। এখানে শীতকালে বসে হাজার পাখির মেলা, বন্যকুকুর আর সাপের অভয়ারণ্য এই বনের সবুজ ঘাস চিরে সারাদিন দৌড়ে বেড়ায় চিত্রা হরিণের দল। এই হলো নিঝুম দ্বীপ। একটু সময় বের করে প্রিয়জনের সাথে বেরিয়ে পড়তে পারেন এই দ্বীপের উদ্দেশ্যে। যাত্রা শুভ হতে বাধ্য!
ভ্রমণ পরামর্শ:
১. চেয়ারম্যান ঘাট হতে প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর ট্রলার ছাড়ে, আর বিকেল ৫টার পর ট্রলার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়,
২. ক্যাম্পিং করার প্রয়োজনীয় সবই নামার বাজারে পাওয়া যাবে,
৩. নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎব্যবস্থা নেই। তাই মোবাইলের এক্সট্রা ব্যাটারী বা পাওয়ার ব্যাংক সাথে রাখা উচিত।
ধন্যবাদ!