বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসেছেন, গান বাজনা হচ্ছে জম্পেশ। আর এই জম্পেশ আড্ডায় গলা ছেড়ে “সেই তুমি কেনো এত অচেনা হলে” গানটি একবারও গাননি এমন “বাঙালি” খুঁজে পাওয়া বোধহয় দুস্কর। বাংলাদেশী না বলে “বাঙালি” বললাম কারন এই গানের যিনি স্রষ্টা আমাদের প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু, তিনি যে শুধু বাংলাদেশেই জনপ্রিয়, বিষয়টা এমন নয়। সীমানা পেরিয়ে ওপার বাংলার যে অংশটুকু রয়েছে সেখানেও তিনি সমানভাবেই জনপ্রিয়। তাই বাংলাদেশ হোক বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা গান রয়েছে সেখানেই আছেন আইয়ুব বাচ্চু এবং থাকবেন।
শুরুটা হয়েছিলো জন্মভূমি চট্রগ্রাম থেকেই। লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এদের দেখেই মনের মধ্যে রক মিউজিকের নেশা চাপে তার। এদের মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গিটার বাজানো সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো তার। জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ যিনি তখন চট্রগ্রামে থাকতেন, তার কাছে গিটারে হাতেখড়ি নেওয়া শুরু করেন। এক বন্ধুর কাছ থেকে গিটার নিয়ে প্র্যাকটিস করতেন তিনি। পরে সেই বন্ধু তাকে গিটারটি উপহারই দিয়ে দেন।
কলেজ জীবনের সহপাঠী আরেক সঙ্গীত কিংবদন্তী কুমার বিশ্বজিৎকে নিয়ে গোল্ডেন বয়েজ (পরবর্তীতে নাম পাল্টে আগলি বয়েজ রাখা হয়) নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন। সে সময় চট্রগ্রামের বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান ও ক্লাবে গান করতেন তারা। নিজের ব্যান্ডের পাশাপাশি এ সময় তিনি আরেক রকস্টার জেমসের সাথে ফিলিংস ব্যান্ডেও বাজান বেশ কয়েকদিন। ১৯৮০ সালে সোলসে যোগ দিয়ে প্রায় দশ বছর সেখানে কাজ করেন। সোলসের বিখ্যাত গান মন শুধু মন ছুয়েছে তারই সুর করা। এরপর সোলস থেকে বের হয়ে ১৯৯১ সালে একদম নিজের মন মতো ধারার গান করার জন্য তৈরি করেন ব্যান্ড এলআরবি। তারপর থেকে এলআরবি বাংলাদেশের রক সিনে ছুটেছে একদম পাগলা ঘোড়ার মত, যাকে থামানোর সাধ্য কারো ছিলোনা।
ডিস্টর্টেড গিটার টোনের সাথে হেভি ড্রাম রোলিং আর গ্রুভি বেজ বাংলা গানে এসব কল্পনা করাই ছিলো যে সময়ে অবাস্তব সে সিন্থেসাইজারের যুগে আইয়ুব বাচ্চু তার অ্যালবাম করেছিলেন এসব দিয়েই। ৯০ এর দশকে হাসান আর জেমসের পাশাপাশি আইয়ুব বাচ্চু এই ট্রায়োকে মানুষ খুব দারুণভাবেই গ্রহণ করেছিলো। বাংলা রক মিউজিকের স্বর্ণ যুগই বলা চলে সে সময়কে। অনেক হেভিওয়েট আর্টিস্টদের মাঝে একসাথে প্রতিযোগিতা করেও আইয়ুব বাচ্চু সবসময়ই নিজেকে আলাদা করে সবার কাছে চিনিয়েছেন। জেমসের পাশাপাশি তিনিও রক গান দিয়েও মিশে গেছেন সব শ্রেনীপেশার মানুষের মধ্যে।
আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম বাজারে আসা মানেই সে সময় এক অদ্ভুত উন্মাদনা। রক মিউজিক করার জন্য সোলস ছাড়লেও নিজের একক ক্যারিয়ারে অনেকগুলো পপ গানও করেছেন তিনি এবং সেগুলো তার রক গানের মতই সমান জনপ্রিয়। এছাড়া ব্লুজ, জ্যাজ নিয়েও কাজ করেছেন। গান গেয়েছেন বাংলা সিনেমাতেও। মানে একদম পারফেক্ট প্যাকেজ বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি একসাথে সিঙ্গার, সং রাইটার, টিউনার। তবে নিজেকে সবসময় গায়কের চেয়ে গিটারিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।
শুধু বাংলাদেশ নয় ওপার বাংলাতেও অনেক জনপ্রিয় শিল্পী গানবাজনা করার অনুপ্রেরনার নাম আইয়ুব বাচ্চু। স্টেজে উঠেই নিজেই গান গাচ্ছেন আবার নিজেই সলো বাজাতে বাজাতে অডিয়েন্সের সাথে মিশে যাচ্ছেন এমন দৃশ্য বাংলা রক সিনারিওতে আর কোনোদিনই হয়তো দেখা যাবেনা, কারন রুপালী গিটারের সম্রাট আমাদের ছেড়ে গেছেন আজ এক বছর হলো। কিন্তু যতদিন বাংলাদেশ আছে বাংলা গান আছে ততদিন বেঁচে থাকবেন আইয়ুব বাচ্চু।