মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেই আমাদের চোখের সামনে মূলত আমাদের যুদ্ধকালীন গ্রাম বাংলার ছবি ভেসে ওঠে, তবে এর অবশ্য বিশেষ একটি কারন রয়েছে। কারণ আমাদের যুদ্ধভিত্তিক অধিকাংশ সিনেমা বা ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন সবই আসলে গ্রামকে ঘিরে কিন্তু যুদ্ধ কিন্তু কেবল গ্রামেই হয়নি শহরেও হয়েছে। এমনকি যুদ্ধের শুরুটাই কিন্তু এখান থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সবচেয়ে শক্ত ঘাটিটাই ছিলো ঢাকায়, তা সত্ত্বেও বুকের ভেতর আগুন জমা কিছু সাহসী তরুন পাকিস্তানী বাহিনীর শক্ত ঘাটিতেই তাদের কাপিয়ে দিয়েছিলো। তারা আর কেউ নয়, তারা ক্র্যাক প্লাটুন। আরবান ওয়ার সিনারিওতে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য এবং ভয়ংকর একটি বাহিনী এই ক্র্যাক প্লাটুন। পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তির বিপরীতে এদের তেমন কিছুই ছিলো না তবে যা ছিলো তার নাম সাহস, একটি স্বাধীন দেশের জন্য লড়াই করার সৎ সাহস। যার ফলে তৎকালীন সময়ের অন্যতম ওয়েল ট্রেইন্ড সামরিক বাহিনীর ভিত কাপিয়ে তাদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিতে বাধ্য করেছিলো আমাদের ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধারা।
কিভাবে শুরু এই ক্র্যাক প্লাটুনের এবং কেনো এই নামকরন?
মেজর মোহাম্মদ খালেদ মোশাররফ এবং মেজর হায়দারের অধীনে ঢাকা শহরের একদল মুক্তিপাগল তরুনদের নিয়ে তৈরি হয় ক্র্যাক প্লাটুন।মূলত হিট এন্ড রান এর মত ঝটিকা অথবা গেরিলা আক্রমনের জন্য এরা বিখ্যাত ছিলো, এক মুহূর্তেই ঝড়ের মত এসে লক্ষ্যবস্তুতে অর্থাৎ পাকি হানাদারদের আস্তানা লন্ডভন্ড করে চলে যাওয়াই ছিল এদের প্রধান কাজ। ৯ জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৃথিবী কাপানো গ্রেনেড হামলার গেরিলা অপারেশন দিয়ে শুরু করে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রায় একশর মত গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে সমগ্র ঢাকা জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো এই ক্র্যাক প্লাটুন। এই দলের অনেক সদস্য পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মারা পড়লেও কোনভাবেই এদের দমানো যায়নি। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড চার্জ ও গুলি ছুড়তে হবে; যা ছিলো অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ও অচিন্তনীয় কাজ। কিন্তু দু:সাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে বসলো এবং বেশ কয়েকজন পাকিকে হত্যা করলো।
সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বললেন,
‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালেই কিনা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে!!’
তিনিই প্রথম এই দলটিকে “ক্র্যাক” আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে এই প্লাটুনটি “ক্র্যাকপ্লাটুন” নামে পরিচিত হয়।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য কারা?
ক্র্যাক প্লাটুনের সকল সদস্যের সম্পূর্ণ তালিকা এখনো না পাওয়া গেলেও উল্লেখ্যযোগ্য কিছু “ক্র্যাক প্লাটুন” সদস্য হলেন-
আবুল বারক আলভী, শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী, জুয়েল বীরবিক্রম, পপ সম্রাট আজম খান, আমিনুল ইসলাম নসু, আলী আহমেদ জিয়া উদ্দিন বীরপ্রতীক, ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, কাজী কামাল উদ্দিন বীরবিক্রম, কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক, চুল্লু, জহির উদ্দিন জালাল, জহিরুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নীলু, পুলু, ফতেহ চৌধুরী, শহীদ বদিউজ্জামান, বদিউল আলম বদি বীরবিক্রম, মতিন ১, মতিন ২, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, মাহবুব, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মাযহার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, লিনু বিল্লাহ, শহীদ শাফি ইমাম রুমী, শহীদুল্লাহ খান বাদল, শাহাদত চৌধুরী সামাদ, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, হিউবার্ট রোজারিও হ্যারিস
শহীদ শাফি ইমাম রুমী
উল্লেখ্যযোগ্য কিছু অপারেশনঃ
অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল
অপারেশন গ্যানিজ পেট্রলপাম্প
অপারেশন দাউদ পেট্রলপাম্প
অপারেশন এলিফ্যান্টরোড পাওয়ার স্টেশন
অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন
অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন
অপারেশন ফার্মগেট চেকপয়েন্ট
অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার
এটাক অন দ্য মুভ প্রভৃতি।
পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙে তাদের ভিত কাপিয়ে দেওয়া এই বীরদের সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি। কিন্তু দেশের জন্য খুব সহজেই বুক চিতিয়ে জীবন দেওয়া এই বীরদের সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বলতে পারি উই অলসো হ্যাড অ্যা গ্রেট আরবান গেরিলা গ্যাং এন্ড রিমেম্বার দেয়ার নেম, দে আর- দ্য গ্রেট ক্র্যাক প্লাটুন