একটি জাতিকে কয়েকশো বছর পিছিয়ে দিতে চাইলে সবচেয়ে সহজ সমাধানটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে তাকে দুর্বল করে দেওয়া, আর এই কাজটি তখনই সম্ভব হয় যখন সেদেশের বুদ্ধিজীবীদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া যায়। ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নামক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির পশ্চিম অংশ দেশভাগের পর থেকেই বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে। একে একে আঘাত হানতে শুরু করে বাঙালির সংস্কৃতি এবং ভাষার উপর। ফলশ্রুতিতে সাধারণ বাঙালির মনের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে একসময় রূপ নেয় সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে, আর সাধারণ বাঙালির মনে ক্ষোভের এই আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার কাজটি একদম সম্মুখে থেকেই করেছিলেন বাংলার সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা, আস্তে আস্তে এই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে উঠেন। পাকিস্তানি শাসকরা নানাভাবে চেষ্টা করেন তাদের দমিয়ে রাখতে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন সে সময় গণজোয়ারে পরিণত হওয়ায়, শেষমেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তারা বেছে বেছে এই বুদ্ধিজীবীদের মারতে শুরু করে। পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিলো বাঙালি জাতিকে পুরোপুরি মেধাশুন্য করে ফেলা।
২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের সময়েই বুদ্ধিজীবীদের মারার পরিকল্পনা করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরাট একটি অংশকে সেদিন রাতেই মেরে ফেলা হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের উপরে চলেছে তাদের বিশেষ নির্যাতন। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক দুইদিন আগে ১৪ ডিসেম্বরে তাদের নির্মমতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় সবকিছুকে, যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা পরিকল্পনা করে এদেশের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির শিকড়কে পুরোপুরি উপড়ে ফেলার। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে নির্মম এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুতে তাকে সহযোগিতা করে কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যায়ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলো আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী।
রাও ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিলো শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির” প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করলেও সে অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারেনি তার দোসররা। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকেই কারফিউ জারি করে দেওয়া হয় ঢাকায়, ১০ তারিখ থেকে শুরু হয় হত্যাকান্ডের প্রস্তুতি, এরপর ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী সাংবাদিক, অধ্যাপক, প্রকৌশলী, শিল্পী এবং লেখক-সহ চিহ্নিত সকল বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা অপহরণ করে।
সেদিন প্রায় ২০০ জন বা তারও বেশি বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রাজারবাগ, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুরসহ আরো বিভিন্ন জায়গার নির্যাতন কেন্দ্রে। বীভৎস নির্যাতন চালানোর পর নৃশংসভাবে হত্যা করে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয় এসব বুদ্ধিজীবীদের লাশ। শহীদুল্লাহ কায়সার থেকে শুরু করে আলতাফ মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী, কবি মেহেরুন্নেসা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ আরো অসংখ্য শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় এদিনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় গণকবর খুঁজে পাওয়া গেলেও অনেকের লাশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র একজন রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে কয়েশো বছর, জাতি হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যে ক্ষতি কোনদিনই পূরণ হবার নয়।