আর দশটা দিনের মত শহর সেদিন ঘুমিয়েছিলো, কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি কি হতে যাচ্ছে এ এদেশের ইতিহাসে। লেখা হচ্ছে নতুন ইতিহাস। হ্যা, কথা হচ্ছে ২৫ মার্চ রাত নিয়ে। যেদিন এদেশের বুকে রাতের আধারে ছুরির ফলার মত অতর্কিত হামলা চালিয়েছিলো পাকিস্তানি বাহিনী। নির্বিচারে মেরেছিলো হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে।
কিন্তু সেদিনও কিছু মানুষ এ ধরণের অতর্কিত হামলার বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলো প্রতিরোধ। যেখান থেকে সূচনা হয়েছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের স্বাধীনতার। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের তখনকার অসমসাহসী মানুষ সেদিন পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আর মর্টারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো মাত্র কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল নিয়ে। যাদের বীরত্বের ফলশ্রুতিতে পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরে প্রতিরোধের আগুন।
যেভাবে শুরু:
২৫ মার্চ বিকাল থেকেই রাজারবাগের আশেপাশে রেকি করা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। আর রাত ৯ টার পর খবর আসতে থাকে যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলা হতে পারে। সে সময় পুলিশ লাইনসে কন্সটেবলের দায়িত্বে থাকা আব্দুল আলী পাকিস্তানিদের হামলার কথা আঁচ করে পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেস্টা করেন। কিন্তু তাদের না পেয়ে বাধ্য হয়ে পাগলা ঘন্টা বাজান, ঐ ঘন্টার আওয়াজ শুনেই বাকি সব পুলিশ সদস্যরা সালামি গার্ডে জড়ো হন। সালামি গার্ডে জড়ো হওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে প্রায় ৪ শতাধিক অস্ত্র নিয়ে রাজারবাগ এবং এর আশপাশে পজিশন নেন।
রাত ১১ টায় দ্বিতীয়বার পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে অস্ত্রাগারের অস্ত্র বাকিদের মাঝে বিলি করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজারবাগের দিকে আসতে শুরু করলে রাত ১১.৫০ এ চামেলীবাগের দিকে প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। সেখানে পুলিশের গুলিতে দুই পাক সেনা নিহত হয়। স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম বুলেট ছিলো সেটিই।
সেসময় ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন শাহজাহান মিয়া। তিনি একটি ওয়্যারলেস বার্তা লিখে তা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ১৯ টি জেলা, ৩৬টি সাব ডিভিশন এবং সব পুলিশ লাইন্সে জানিয়ে দেন৷ বার্তাটা ছিল: “দ্য বেস ফর অল স্টেশন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, কীপ লিসেনিং, ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাক্ড বাই পাক আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ্, ওভার এন্ড আউট”।
এরপর বাকি যারা ছিলো তারাও পজিশন নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এই সম্মুখ সমরে বাংলাদেশি পুলিশরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি ট্রেইনড আর্মির সুসজ্জিত ট্যাংক মর্টারের বিরুদ্ধে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে টানা সাড়ে তিন ঘন্টা যুদ্ধ চালিয়ে যান। এই সাড়ে তিন ঘন্টায় পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনসের ধারে কাছে ঘেষতে পারেনি। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে তখন পাকিস্তানি বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করলে কিছু পুলিশ সদস্য পরবর্তীতে যুদ্ধের জন্য ওখান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাকিদের উপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। প্রায় দেড়শর মত পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান স্বাধীনতা যুদ্ধের এই প্রথম সম্মুখ সমরে। সেদিন আমাদের পুলিশ হেরে গেলেও যে পাগলা ঘন্টা বেজেছিলো সে রাতে তার আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছিলো বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায়। প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল সারা দেশে। এবং অবশেষে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের সূর্য।
কার্টুনিস্ট – কাজী তাবাস্সুম আহমেদ