চারশো বছরের পুরনো এই শহর। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও এখনো যেসব জিনিস এই শহরের বুক থেকে মুছে যায়নি তার মধ্যে একটি বাকরখানি। না রুটি না বিস্কুট কোনটিই নয় ডালডা/তেল, আটার তৈরি অদ্ভুত এক খাবার যুগের পর যুগ ধরে পুরান ঢাকাবাসীর মন জয় করে যাচ্ছে। পুরান ঢাকায় গেলে এমন স্থানীয় বাসিন্দা খুব কম পাওয়া যাবে যার সকালের বা বিকালের যেকোনো একবারের নাস্তার আইটেমে বাকরখানি থাকেনা। অনেকে আবার চিনি বা পনির দিয়ে তৈরি বাকরখানি খেতেও বেশ পছন্দ করেন।
শুধু পুরান ঢাকাবাসী কেনো নতুন ঢাকার বা অন্যন্য জেলার মানুষজনের কাছে বাকরখানি আকর্ষণীয় এক খাবার। ঝাল মিস্টি সব কিছু দিয়ে খাওয়া গেলেও মূলত দুধ চায়ের সাথে বাকরখানির যে ভালোবাসা তা আপনি অন্য কোন কিছুর সাথেই তুলনা করতে পারবেন না তবে হ্যা একটা জিনিসের সাথে তুলনা করা যায় তা হলো বাকরখানি সৃষ্টির ইতিহাস। আগা বাকের আর খনি বেগমের ব্যর্থ প্রেমের ফলস্বরূপ ই সৃষ্টি হয় অনবদ্য এই খাবার।
আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। তখনকার বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ সুদর্শন এ বালককে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারেই বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় যাকে আমরা এখন বরিশাল নামে চিনি।
আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। খনি বেগমের প্রেমের মনোনয়ন প্রত্যাশী একমাত্র যুবক তো সে নয়। উজির জাহান্দার খাঁর পুত্র জয়নাল খাঁও মারাত্মক পছন্দ করে খনি বেগমকে। জয়নাল নগর কোতোয়াল হতে পারে, কিন্তু ভালবাসার জন্য ভিন্ন রকমের সাহস লাগে। সে খনি বেগমের সামনে দাঁড়ালো, গিয়ে সত্যি সত্যি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো খনি বেগমকে। কিন্তু খনি বেগম উজিরের পুত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলো। জয়নাল মেনে নিতে পারলো না। সে খনি বেগমকে জোর জবরদস্তি করতে গেলে খবর পেয়ে আগা বাকের সেখানে যান। এটাই তো সুযোগ। তিনি জয়নালের সাথে মল্লযুদ্ধ শুরু করলেন। যে জিতবে খনি বেগম তার। যুদ্ধে জয়নাল হেরে যায়। এইদিকে উজিরের কাছে মিথ্যা খবর দেয়া হয়। তাকে বলা হয়, তার ছেলে জয়নালকে আগা বাকের হত্যা করে লাশ গুম করে রেখেছে। উজির নবাবের কাছে বিচার চাইলে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ আগা বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার হুকুম দেন। শক্তিধর আগা বাকের বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরের মতো বেরিয়ে এসেছিলেন।
ততক্ষণে খনি বেগমকে অপহরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের গহীনে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধারে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন বাকের-খনি।পুরান ঢাকার প্রখ্যাত লেখক নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে এই কথার। যা কালক্রমে লোকমুখে পরিবর্তিত হতে হতে বাকরখানি হয়ে গিয়েছে এখন। তবে পুরান ঢাকায় অনেকে একে শুকা রুটি নামেও ডেকে থাকে।