জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে?’ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা হতে আমরা এমনই কিছু বাণী পাই। যশোরর কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই মহাকবি। মাইকেলের ছোটবেলায় পড়ালেখায় হাতে খড়ি হয় মায়ের কাছে, পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হোন। ১৮৪২ সালে, যখন তিনি সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি হঠাৎকরেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান! পরে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর নামের সাথে ‘মাইকেল’ নামটি যুক্ত হয়। পিতা রাজনারায়ন দত্ত লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে পুত্রকে ধর্মান্তরে বাধা দিবেন বলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মাইকেলকে আশ্রয় দেয়া হয়।
খ্রিস্টানদের হিন্দু কলেজে পড়ার অধিকার না থাকায় কবিকে দুই বছর পর শিবপুরে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। এখানে কয়েক বছর কাটিয়ে ১৯৪৮ এর গোড়ার দিকে তিনি পাড়ি দেন মাদ্রাজে। সেখানে একটি বিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি শিক্ষকের দায়িত্ব পান। অল্পদিন পর তিনি তার প্রথম বিবাহ করেন। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।
পরবর্তীতে ১৮৬২ সালে তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি শিখবার জন্য। কিন্তু টাকার অভাবে কোনরকমে ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝিতে সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রায় অনেককাল কলকাতা থেকে টাকা না আসায় শোচনীয় অবস্থায় পড়েন কবি। এসময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দেয়া দেড় হাজার টাকাসহ বিভিন্ন জায়গা হতে ধার করে তিনি ১৮৬৫ সালে ব্যারিস্টার হয়ে বেরুলেন।
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন(অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৫ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আসুন জেনে নেই কবি সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্যঃ
#১
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছদ্মনাম ছিল টিমোথি পেনপোয়েম। এই নামে তিনি অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদ ও পিতৃবিয়োগের পর তিনি কলকাতায় ‘মি. হোল্ট’ ছদ্মনাম ধরে যান।
#২
#৩
বাংলা সাহিত্যের প্রতি কবির অবজ্ঞা দেখে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে কবিতা রচনা করলে তিনি ‘বর্ষাকাল’ কবিতাটি লিখেন। এই কবিতার প্রতিটি পংক্তির প্রথম অক্ষরগুলোর মিলয়ে লিখলে একটি নাম পাওয়া যায়, গৌরদাস বসাক। ইনিই কবির সেই বন্ধু যার অনুরোধে তিনি কবিতাটি রচনা করেন।
#৪
মাদ্রাজে যাওয়ার পর কবি যে অনাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সেই বিদ্যালয়ের বালিকা বিভাগের ছাত্রী রেবেকা ম্যাকটিভিসকে বিবাহ করেন। পরে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তিনি এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে একজন ফরাসি নারীকে বিয়ে করেন এবং এই ঘরে শর্মিষ্ঠা, মিল্টন ও নেপোলিয় নামের তিনজন সন্তান রয়েছে কবির।
#৫
#৬
গ্রীক কবি হোমারের দ্বারা মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্টিসমগ্র অনেকখানি প্রভাবিত ছিল।
#৭
যখন মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচনা করে মাইকেল সাফল্যের চূঁড়ায় আরোহন করেছেন, এই সময় একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর কবি খেয়াল করলেন রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার মেঘনাদবধ কাব্যটি পড়ছে। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করলে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার উত্তর দেন, ‘ বাবু! আপনি এত কঠিন জিনিস বুঝবেন না। এটা মধুসূদন বাবুর লেখা!’
#৮
#৯
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধারে প্রথম সার্থক নাট্যকার, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, প্রথম প্রহসন রচয়িতা, প্রথম পত্র কাব্যকার, বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচয়িতা, প্রথম ট্রাজেডি রচয়িতা এবং অন্যান্য।
#১০
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘হিন্দু ক্রনিক্যালস’ ও ‘Athenaeum’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
#১১
কবির জন্মবার্ষিকীর স্মরণে প্রতিবছর ২৫ শে জানুয়ারি যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে এখনো সপ্তাহব্যাপী ‘মধুমেলা’ আয়োজিত হয়।