আপনাকে ছোটবেলায় কে খাইয়ে দিত? আমার কথা বলি। আমাকে খাইয়ে দিতেন আমার বাবা এবং আমার আপু। যখন বাবা বাসায় থাকতেন তখন আমি আর আপু দুইজনেই খাওয়ার জন্য বাবাকে ঘিরে বসে থাকতাম। বাবা না থাকলে আপু তো ছিলোই। গল্প বলে বলে খাইয়ে দিত। একসময় ওর জানা গল্প গুলো ফুরিয়ে গেলে নিজেই বানিয়ে বানিয়ে বলতো। প্লেটের মধ্যে মাখানো ভাতের বল বানিয়ে সাজিয়ে রাখতো সুন্দর করে। ওই বল গুলোর নাম দিতো আমি যাদের খুব পছন্দ করি তাদের নামে। যেমন- বাবা, মা, আপুর নিজের নাম কিংবা আমার বন্ধুদের নাম। এতে করে দেখা যেত খাওয়ার শেষের দিকে যখন দুই-তিনটা বল বাকি থাকতো তখন আপু আমাকে ইমোশোনাল ব্লেকমেইল করতো। বলতো, “এগুলা পাতে রেখে দিলে তো ওরা (যাদের নামে বল) কষ্ট পাবে”। তাই আমিও প্রিয়জনদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে নিতাম।
এটা তো গেল আমার ছোটবেলার কথা। এখন বলি আজকালের বাচ্চাদের অবস্থা। আমার ভাতিজার কথাই বলা যাক। ওর নাম আরাফ। ও আমার বড় ভাই এর একমাত্র ছেলে। বয়স ৫ বছর। ওকে ওর মা বাবা কখনো শুধু খাবার খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে খাওয়াতে পারেন না।
ওকে খাওয়ানোর সময় টিভি অন রাখতে হয়, টিভি না থাকলে স্মার্টফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাখতে, স্মার্টফোন না থাকলে ল্যাপটপ চালু করে রাখতে হয়। সে তখন স্ক্রিনের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে আর সেই “হা” এর মধ্যে খাবার পুরে দেন ওর মা। মাঝে মাঝে দেখে সন্দেহ হয় এই বাচ্চা খাবার খাচ্ছে, সেটা আদৌ ও নিজে জানে কি না। আমি ভাইয়া ভাবিকে বুঝিয়েছি বহুবার। কিন্তু তারা ওই প্র্যাক্টিস বাদ দেওয়ার অনুশীলন করেন না। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, ও ক্ষুধা লাগলেও নিজে থেকে কিছু বলে না। বারবার জিজ্ঞেস করতে হয়। তারপর কখনো রাজি হয়, কখনো হয় না। একদিন দুপুরের ঘটনা বলি। ওকে আমার কাছে রেখে বাইরে গিয়েছিল ওর মা। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছি বার বার যে, “আরাফ ক্ষুধা লাগসে না তোমার? চলো খাই দুজনে মিলে”। কিন্তু ও চুপ করে বসে আছে। এমন নয় যে ওর আম্মু ওকে নিয়ে না যাওয়ায় মন খারাপ। একটু আগ পর্যন্তও বাসা ভর্তি খেলনা দিয়ে খেলল। এখন নিশ্চয় ক্লান্তবোধ করার কথা, ক্ষুধা তো লেগেছে অবশ্যই। আরো কয়েকবার ডাকলাম। পরে ওর হাতে ধরে নিয়ে এসে বসালাম আমার পাশে। বললাম, “চাচ্চু অল্প করে খাও আমার সাথে”। সে আস্তে আস্তে খাওয়া শুরু করলো। আমার খাওয়া আগেই শেষ হলো। তাও বসে থেকে খাওয়ার ভাণ করে গেলাম। কিছুক্ষন পর দেখি ওরও খাওয়া শেষ। কিছু না বলে প্লেটে আবার খাবার নিয়ে এসে দিলাম। এবারও আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলল পুরোটা। আমি ভাবতে লাগলাম, তাহলে অন্য সময় কেন এতো বাহানা করে ও?
কারণ ও ক্ষুধা লাগলে বুঝতে পারে না। পারে হয়তো, কিন্তু আমাদের মত স্বাভাবিকভাবে না অন্তত। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে ও কখনো খাবারের আসল স্বাদ নিয়ে খায়-ই নি। তাই যত মজার খাবারই ওকে দেওয়া হোক না কেন, তার সাথে পানি আর স্ক্রিনের উপস্থিতি দুইটাই লাগে। এরকম শৈশবের পরিণতি কেমন তা আমার জানা নেই। কারন এভাবে আমরা বা আমাদের আশেপাশের কেউ বড় হই নি। ওরাই নতুন প্রজন্ম। এটা শুধু আমার পরিবারেই না। একটা ছোট্ট প্রমান দিচ্ছি, Youtube এ গিয়ে দেখবেন বাচ্চাদের বিভিন্ন কার্টুন আছে। আমরা ডিজনি বা কার্টুন নেটওয়ার্কে যেসব কার্টুন দেখে বড় হয়েছি সেসব নয়। বিভিন্ন ইউটিউবারদের বানানো কার্টুন। একবার সেগুলোর ভিউ সংখ্যা খেয়াল করে দেখবেন। কোনো হিট জনপ্রিয় গান কিংবা আলোচিত কোনো মুভির ট্রেইলারের চেয়েও সেসব ভিডিওর ভিউ অনেক অনেক বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এগুলা কারা দেখে? আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হবে যে কারা তাদের সন্তানকে এসব ভিডিও দেখায়?
আজকালের মা বাবারা ধৈর্যের দিক দিয়ে আমাদের বাবা মায়েদের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। ধৈর্য ধরে নিজের সন্তানকে খাবারটা ঠিকমত খাওয়াতে পারেন না তারা। খুব অল্পতেই উনারা হাল ছেড়ে দেন। এরকম চলতে থাকলে এমন একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠবে যারা প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ এর মধ্যে থেকেও অপুষ্টিতে ভুগবে এবং শিক্ষিত মায়ের সান্নিধ্য পেলেও প্রকৃত যত্নের কাঙাল থেকে যাবে।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই নতুন প্রজন্মের এইসব বাবা মাকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়- আপনার সন্তানকে খাইয়ে দেয় কে? আপনি নাকি আপনার স্মার্ট ডিভাইস?