“ওরা বলে, ঐ গাড়িতে করে আমাদের জন্য খাদ্য আর পানীয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন বন্ধুগণ, আমি জানি ঐ গাড়িতে আমাদের জন্য কোন খাদ্য ছিল না, আমাদের জন্য কোন পানীয় ছিল না। ৩০০ লাশ…। ৩০০ টি লাশ ঠাণ্ডা, হিম! যাদের খুন করে ফেলা হবে। আমি বলতে চেয়েছিলাম সেই সত্য কথা। আর তখনই আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্ধত রাইফেল। আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্ধত বেয়োনেট। ওরা বলে খামোশ…। তবুও বন্ধুগণ, আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।”
কথাগুলো সঞ্জীব চৌধুরীর, টিএসসির মোড়ে হাতে মাইক নিয়ে বুক চিতিয়ে সে সময় কথাগুলো বলেছিলেন, চারদিকে যখন বেয়নেট আর জলপাই রঙের দাপট। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে তার মতো এমন করে সাহস আর কেউ নিজের লেখনি বা গানে দেখাতে পারেনি। প্রেম, দ্রোহ, বিপ্লব সবই ছিলো তার গানে। নিজেকে কখনও একটা জায়গায় আটকে রাখেননি, গান গাওয়া লেখার পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন, ছোটগল্প কিংবা নাটক লেখা, সব জায়গাতেই ছিল তার সমান দক্ষতা। “সুখের লাগিয়া” নামক একটি নাটকে অভিনয়ও করেছেন।
জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার মাকালকান্দি গ্রামে, বাবার নাম গোপাল চৌধুরী এবং মায়ের নাম প্রভাষিণী চৌধুরী। জন্ম হবিগঞ্জে হলেও সঞ্জীব চৌধুরীর মূল বাড়ি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে। সেখানকার জমিদার শরৎ রায় চৌধুরীর নাতি ছিলেন তিনি। জমিদার বংশের ছেলে হয়েও সবসময় থেকেছেন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। ছোটকাল থেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন সঞ্জীব চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাজনীতির সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে যান। মূলত বাম ঘরানার রাজনীতি করতেন তিনি, ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে পুরোপুরি সক্রিয় ছিলেন, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন রাস্তায় রাস্তায়। এসময়টায় রাজপথ বহুবার প্রকম্পিত হয়েছে সঞ্জীবের কবিতা আর বক্তৃতায়।
ভালোবাসতেন বব ডিলান, পিংক ফ্লয়েডের গান, পাশ্চাত্যের এসব শিল্পীর গানের পাশপাশি লোকসংগীতের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। শাহ আবদুল করিমের “গাড়ি চলে না” গানটি নিজের ব্যান্ড দলছুটের সাথে করেন, যা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। আমাদের অনেকেই এখন জানি না কিন্তু বাংলা পত্রিকায় ফিচার বিভাগ চালুর ক্ষেত্রে রয়েছে তার বিশেষ অবদান। নব্বইয়ের দশকে সংবাদপত্র শুধু সংবাদ দিয়েই ভর্তি থাকতো, ভোরের কাগজে কাজ করার সময় তিনিই প্রথম ফিচার লেখা শুরু করেন, এতে পত্রিকার কাটতি অনেকগুণ বেড়ে যায়, ভোরের কাগজের দেখাদেখি তখন অন্যান্য পত্রিকাগুলোও ফিচার বিভাগ চালু করা শুরু করে।
নিজের গানের সেই পাগলের মতো একদিন কষ্ট চেপে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন সঞ্জীবদা। ২০০৭ সালের ১৭ নভেম্বর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যু হয় তার। তার স্মরণে প্রতিবছর তার জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সঞ্জীব উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে মধ্যরাত থেকে বিকাল অবদি গান করে বিভিন্ন শিল্পী। সঞ্জীব চৌধুরী শুধু একজন মানুষ বা আর দশজনের মতো শিল্পী ছিলেন না, সঞ্জীব ছিলেন একজন আদর্শ। কারণ গান গেয়ে বিনোদন দেওয়ার চেয়ে গানকে মানুষের অন্তরের গভীরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি তার মতো করে খুব কম শিল্পীরাই পেরেছে।